থাইলেরিয়াসিস রোগের, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার
আপনি কি আপনার গবাদি পশু বা গরুর খামারের থাইলেরিয়াসিস রোগ নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন। এ রোগের কারণে ,আপনি লাখ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।থাইলেরিয়াসিস রোগ থেকে আপনার খামার কে মুক্তির জন্য আপনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
কিন্তু কিভাবে থাইলেরিয়াসিস রোগের, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার করতে হয়, সে বিষয়ে আপনি জানেন না বা সঠিক তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না।তাহলে আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। আজকের এই আর্টিকেলে থাইলেরিয়াসিস রোগের, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আপনি যদি এইসব গুরুত্বপূর্ণ টপিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তাহলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আশা করি, আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য খুঁজে পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
সূচিপত্রঃথাইলেরিয়াসিস রোগের,কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে জানুন
.
গরুর থিলেরিয়া রোগ কি?
থাইলেরিয়াসিস হলো গবাদি পশুর রক্তবাহিত এক ধরনের প্রোটোজোয়াজনিত একটি মারাত্মক রোগ। সাধারণত এ রোগের জীবাণু গরু, মহিষ, ছাগল সহ অন্যান্য গবাদি পশুকে আক্রান্ত করে। গ্রীষ্মকালে এ রোগের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি বেশি হয়। এবং এই রোগটি আঠালের মাধ্যমে দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
থাইলেরিয়াসিস রোগের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত গরু বা গবাদি পশু থেকে সুস্থ গবাদি পশুতে সংক্রমিত করার প্রধান মাধ্যম হলো আঠালি। অর্থাৎ আঠালির মাধ্যমে এ রোগটি অসুস্থ গরু থেকে সুস্থ গরুতে আক্রমণ করে।গ্রীষ্মকালে এ রোগের পাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয় তাই গ্রীষ্মকালকে এ রোগের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময় বলা হয়।
এর প্রাথমিক ও প্রধান কারণ হলো, এ রোগের বাহন আঠালি গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি বংশবিস্তার করে থাকে এবং দ্রুত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে থাইলেরিয়াসিস রোগ দেখা যায় । এ রোগটি Thelileria গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রোটোজোয়ার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের গরুতে এ রোগের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, হলেও থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রায় ৯০ থেকে ১০০ %। এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত পশুর রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অত্যাধিক হারে কমে যায়। ফলে এ রোগটি নির্ণীত হওয়ার পরে চিকিৎসা প্রদান করলেও গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব বিষয় হয়ে পড়ে। কারণ মাঠ পর্যায়ে গরুর রক্ত পরিবহন সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এছাড়াও এ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের ওষুধের। কিন্তু এতে একটি বড় সমস্যা হলো, এ রোগের উন্নতমানের ঔষধের দাম অনেক বেশি এবং তা সব জায়গায় ও সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে থাইলেরিয়াসিস রোগ অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সংকর প্রজাতির গরুকে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ করে।
বর্তমানে আমাদের দেশে সংকর জাতের একটি গাভীর দাম প্রায় ৮০ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। গবাদি পশু বা গরুর খামারে মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ গুলির মধ্যে থাইলেরিয়াসিস রোগ অন্যতম।আমাদের দেশে কম বেশি প্রায় প্রতিটি জেলা এবং অঞ্চলে এই রোগ দেখা যায়।
যেহেতু থাইলেরিয়াসিস একটি প্রোটোজোয়া জনিত রোগ তাই এটি নির্ণয় করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাছাড়া গবাদিপশুর খামারের আশেপাশে বা কাছাকাছি সচরাচর কোন রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থাকেনা। তাই এই রোগ আমাদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন করে।থাইলেরিয়াসিস রোগ প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় কোটি কোটি টাকা গো-সম্পদ নষ্ট করছে।
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগের জীবনচক্র
থাইলেরিয়াসিস রোগের মাধ্যমিক পোষক বা বাহক হিসেবে কাজ করে, প্রায় ছয় প্রজাতির আঠালি। নিম্নে সে আঠালি গুলোর নাম পয়েন্ট আকারে দেওয়া হলো।
Rhipicephalus Spp
Boophilus Spp
Dermacentor Spp
Ornithodoros Spp
Hyalomma Spp
Haemophysalis Spp
বাংলাদেশের সাধারণত Hyalomma Spp প্রজাতির আঠালি প্রোটোজোয়া জনিত থাইলেরিয়াসিস রোগের মাধ্যমিক পোষক হিসেবে কাজ করে।থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত আঠলির লালা গ্রন্থির ভেতরে অবস্থিত Sporozoites রক্ত শোষণের সময় সুস্থ গরু বা পশুর দেহে প্রবেশ করে। এবং এ রোগের জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে গ্রন্থি ও প্লীহার লসিকা কোষ কে আক্রান্ত করে মাইক্রো সাইজন্ট বা ব্ল বডি সৃষ্টি করে।
এবং এটি পরে মাইক্রোসাইজোন্টে পরিণত হয়।রক্ত শোষণের সময় বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে আঠলির দেহে রূপান্তরিত হয়।এবং লালা গ্রন্থিতে অবস্থান করে, যা পরে গবাদি পশুর রক্ত শোষণ করে সুস্থ গরুর দেহে প্রবেশ করে। আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুকে কামড়ানোর প্রায় সাত থেকে দশ দিন পর এ রোগে আক্রান্ত পশুর দেহে প্রচন্ড পরিমাণে তাপ দেখা দেয়।
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগের লক্ষণ কি?
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগ হলে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেগুলো নিচে পয়েন্ট আকারে দেওয়া হলঃ
- গরুর শরীরে প্রবল জ্বর(১০৪-১০৭০ ফারেনহাইট) আসে,
- থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত গরু ক্ষুধা মান্দ্যতা ও রক্তশূন্যতায় ভোগে
- থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার মারাত্মক পর্যায়ে গরু চোখ দিয়ে পানি ঝরে।
- গরুর রুমের গতি হ্রাস পায় এবং লসিকা গ্রন্থি ফুলে যায়।
- অনেক সময় আক্রান্ত গরুর রক্ত ও আম মিশ্রিত ডায়রিয়া এবং লসিকা থেকে শ্লেষ্মা বের হয়।
- থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত গরুর দেহ শুকিয়ে যায়। যার ফলে কোন এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করলে , চিকিৎসার ফল ভালো পাওয়া যায় না।
- থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত গরু যদি গাভী গরু হয়ে থাকে,তাহলে আক্রান্ত গাভীর দুধ উৎপাদন একেবারেই কমে যায়।
- এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে গরু দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে,
- মৃত্যুর পূর্বে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যায়। এবং আক্রান্ত গরু ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে পতিত হয়।
সাধারণত আক্রান্ত গরু থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ১৮ থেকে ২৪ দিনের মধ্যেই মারা যায়।তবে অনেক সময় রোগে আক্রান্ত গরুকে সুস্থ করা যায় কিন্তু আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়ে উঠলেও এটি এ রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে।
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগ নির্ণয়।
কোন গরু থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত কিনা তা নির্ণয় করার জন্য অবশ্যই পূর্বের ইতিহাস ও অভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে হবে। এছাড়াও থাইলেরিয়াসিস রোগ যেহেতু একটি প্রোটোজোয়া জনিত রোগ, তাই রোগে আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত এটি ল্যাবরেটরীতে ট্রেইনে করে অনুক্ষণ যন্ত্রের পাইরো প্লাজমের মাধ্যমে দেখে সঠিকভাবে এই নির্ণয় করা যায়।
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগের সর্বোত্তম চিকিৎসা
সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় না হলে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না। তাই যতদূর সম্ভব দ্রুত এ রোগ নির্ণয় করে মাত্রামত থাইলেরিয়াসিস রোগের ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। তবে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধে কাজ হয় না তাই সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে ভিটামিন ই-১২ সমৃদ্ধ বিভিন্ন ইঞ্জেকশন,(Hartmann’s Solution প্রয়োগ করতে হবে।
যদি সম্ভব হয় তাহলে রক্ত সংযোজন করতে হবে তবে এটি অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ।আক্রান্ত গবাদি পশু বা গরুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে। যেহেতু এ রোগে আক্রমণের ফলে রোগীর দেহে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাই গবাদি পশু বা গরুকে ছায়াযুক্ত আরামদায়ক পরিবেশে রাখতে হবে। এবং প্রচুর পরিমাণে শীতল পানি পান করতে দিতে হবে।
গরুর থাইলেরিয়াসিস রোগ প্রতিরোধের উপায়?
ডেইরি খামার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা উপজেলা গরুর খামারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, এই রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতি ও যেকোনো মূল্যে আপনার খামারকে উকুন, আঠালি ইত্যাদি পরজীবীর হাত থেকে মুক্ত রাখতে হবে। খামার এর আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর গরুকে আঠালি, উকুন জাতীয় পরজীবি নিধনের বা প্রতিরোধের ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হবে।গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে অন্তত দুইবার আপনার খামারে আঠালি নাশক ঔষধ মাত্রামত স্প্রে করলে আপনার খামার আঠালি মুক্ত করা সম্ভব। থাইলেরিয়াসিস রোগে আক্রান্ত এলাকায় সন্দেহজনক সকল গবাদি পশুকে মাত্রামত Buparvaquone diaceturate ইত্যাদি জাতীয় প্রতিষেধক প্রয়োগ করতে হবে।
থাইলেরিয়াসিস রোগের, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে লেখকের মতামতঃ
থাইলেরিয়াসিস রোগ হলো এক ধরনের প্রোটোজোয়াজনিত মারাত্মক রোগ। বাংলাদেশ সহ এশিয়া মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশে কম বেশি এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে এর সংক্রমণ অত্যন্ত কম। এর রোগটি এতটাই মারাত্মক যে এ রোগে আক্রান্ত গবাদি পশু বা গরুর মৃত্যুর হার প্রায় ৯০-১০০% হয়ে থাকে।
সাধারণত গ্রীষ্মকালে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে আর এর মূল কারণ হলো এর প্রধান বাহক। আঠালি গ্রীষ্মকালে প্রচুর বংশবৃদ্ধি ঘটায় ফলে এ রোগ দ্রুত পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।থিইলেরিয়াসিস রোগ একটি মারাত্মক প্রোটোজোয়া জনিত রোগ, সঠিক সময়ে এ রোগের চিকিৎসা না করলে, পরবর্তীতে গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে তাই সঠিক সময়ে ও সঠিক নিয়মে গরুকে এ রোগের চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
আজকের এই আর্টিকেল এর মূল আলোচনার বিষয় হলো থাইলেরিয়াসিস রোগের, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার । থাইলেরিয়াসিস রোগের সম্পর্কে একজন মানুষের যতটুকু জানা দরকার তার সবটুকুই এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি, আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য খুঁজে পেয়েছেন।এতক্ষন আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এরকম গুরুত্বপূর্ণ টপিক সম্পর্কে পড়তে চাইলে, নিয়মিত আমার ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন।
সলভ্ এ টু জেড এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url