গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার

আপনি কি গরুর খামার করতে ইচ্ছুক, কিন্তু বর্তমানে গরুর ভয়াবহ ক্ষুরা রোগ নিয়ে আপনি কি চিন্তিত। গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। 
এই আর্টিকেলে গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এছাড়াও গরুর ক্ষুরা রোগে করণীয় কি, এবং গরুর ক্ষুরা রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আপনি যদি গরুর ক্ষুরা রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। তাহলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আশা করি আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য পেয়ে যাবেন।
সূচিপত্রঃ গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার
.

ভূমিকা

আমাদের দেশে আমিষের চাহিদা অনেক। সে তুলনায় আমিষের যোগান তুলনামূলক খুবই কম । তাই দেশের সম্পূর্ণ আমিষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। এবং দিন দিন মানুষের আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই সেই চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে অসংখ্য গরুর খামার।গরুর খামার তৈরির মাধ্যমে যেমন দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানো সম্ভব ঠিক তেমনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়াও সম্ভব।
তাই আমাদের দেশের বেশিরভাগ তরুণ, গরুর খামার করার উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। কিন্তু গরুর খামারি ভাইদের কাছে একটি বড় সমস্যা হলো ক্ষুরা রোগ। কারণ আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য গরু এ রোগে মারা যায়। পাশাপাশি অনেক খামারিরা লোকসানের সম্মুখীন হন।

তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে এ রোগ থেকে আমাদের খামারকে বাঁচানো সম্ভব। কারণ গরুর ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাস রোগ, তাই এর প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি কার্যকর। এই আর্টিকেল এর মূল আলোচনার বিষয় হলো গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার। তাই গরুর ক্ষুরা রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন।

গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার

বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ ও পরিচিত রোগ হল ক্ষুরা রোগ ।এই রোগটি এক এক অঞ্চলে এক এক নামে পরিচিত। যেমনঃ ক্ষুর পাকা, তাপ রোগ , খুরা ইত্যাদি । এই ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হয় সাধারণত আমাদের দেশে গরু ছাগল ভেড়া মহিষ।অর্থাৎ দুই ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণী প্রায় সবাই এই রোগের শিকার হয়। ক্ষুরা রোগ বছরের যেকোনো সময় হতে পারে ।
এই রোগের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। তবে এ রোগ সাধারণত শীতকালে বেশি দেখা যায়। এই রোগে প্রতিনিয়ত অনেক বাছুর মারা যায় এবং প্রাপ্তবয়স্ক গরুতে ও মারাত্মক প্রভাব ফেলে ।এই রোগে প্রাপ্ত বয়স্ক গরুও অনেক সময় মারা যাই।তবে এ রোগ পুরোপুরি দমন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ রোগের চিকিৎসার চেয়ে বেশি সচেতনতাই কার্যকরী। তাই একটু সচেতন হয়ে সময় মত প্রতিষেধক দিলে গবাদি পশুকে সহজে এ রোগ থেকে রক্ষা করা যায়।

গরুর ক্ষুরা রোগ কি?

ক্ষুরা রোগ অত্যন্ত ভয়াবহ একটি রোগ। এটি ভাইরাস জনিত রোগ। এ রোগ সাধারণত গবাদি পশুর মুখে ও পায়ে হওয়ার কারণে গবাদি পশু খাবার খেতে পারে না। অনেক সময় খুঁড়িয়ে হাটে আবার অনেক সময় গবাদি পশু দাঁড়াতে পারে না।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই কম বেশি এ রোগ দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের কিছু কিছু জায়গায় এ রোগের সংক্রমণ বেশি।এটি ভাইরাসজনিত রোগ হওয়াই এ রোগ কে পুরোপুরি দমন করা যায় না।

গরুর ক্ষুরা রোগের কারণ

ক্ষুরা রোগের কারণ হলো ভাইরাসের সংক্রমণ ।এই রোগ ফুট এ্যান্ড মাউথ ডিজিজ নামক একপ্রকার ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে।বিভিন্ন দেশে এই রোগের নাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে যেমন আমেরিকাতে এ রোগকে এফএমডি বলে।এ রোগকে মোট ৭ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়।
এগুলো হলোঃ
  • সি,
  • স্যাট-১,
  • স্যাট-২,
  • স্যাট-৩
  • এশিয়া-১
  • বাংলাদেশ
  • এশিয়া-২
এই সাতটি ক্যাটাগরির ভাইরাসের সংক্রমণ সব থেকে বেশি।

গরুর ক্ষুরা রোগের বিস্তার

ক্ষুরা রোগ একটি সংক্রমণজনিত রোগ। এই রোগটি ভাইরাস জনিত হওয়ার পাশাপাশি ছোঁয়াচে ও।তাই কোন একটি গরুকে এ রোগ শনাক্ত করলে বা কোন খামারে এ রোগ সনাক্ত করলে। মনে করতে হবে পুরো খামারে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে । এই রোগে জীবাণু রোগান্ত প্রাণীর ফোসকা ফেটে দ্রুত আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
তাই রোগান্ত গরুর মল, লালা , প্রস্রাব, দুধের মাধ্যমে ও এই রোগের জীবাণু বেরিয়ে আসে এবং আশেপাশের পরিবেশকে দূষিত করে এ রোগের বিস্তার ঘটায়। এটি এমন একটি ভয়ঙ্কর রোগ যা রোগান্ত গরু থেকে 70 থেকে 80 কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।অনেক সময় গ্রামের গরুদেরকে হাটে বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

এইসব গরুর মধ্যে যদি রোগান্ত কোনো গরু থাকে, তাহলে এই রোগ হাটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবংক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘাটায়।এই রোগের ভাইরাস বা জীবাণু প্রজনন উপযোগী ষাড়ের জন্য হুমকি স্বরূপ। কেননা এ রোগের জীবাণু ষাঁড়ের প্রজননের জন্য ব্যাঘাত ঘটায়। এবং এর মাধ্যমে অন্য গরুতেও সংক্রমণ ঘটায়। এইসব রোগান্তর গরুর সিমেন ব্যবহার করলে রোগটি মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।

গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ

ক্ষুরা রোগ যেহেতু একটি ভাইরাস জনিত রোগ। তাই এই রোগ অনেকদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই রোগটি প্রায় ২০ থেকে ৫০ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তবে এই সুপ্ত অবস্থায় থাকাকালীন সময় কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে। এবং তা নিচে দেওয়া হলঃ
  • এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হল গরুর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে বা জ্বর হবে
  • মাঝে মাঝে গরুর শরীরে কাঁপুনি দেখা দিবে।
  • গরু খুবই অল্প সময় দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বেশি সময় শুয়ে থাকবে। কিছু কিছু সময় খুঁড়িয়ে চলাফেরা করবে।
  • গরুর পায়ে এবং মুখে ফোসকা বা ক্ষত দেখা যাবে।
  • এই রোগটি বাছুরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মারাত্মক। কারণ বাছুর গরুর লক্ষণ প্রকাশের আগেই বাছুর মারা যায় ।
  • যেহেতু এই রোগ গরুর মুখে ও ও খাদ্যনালীতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। তাই গরুর খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয়।
  •  গরুর মুখ দিয়ে সাদা ফেনাযুক্ত লালা ঝরে ।

গরুর ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা

এই রোগটি ভাইরাস জনিত রোগ তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে সচেতনতা ও পরিচর্যায় এ রোগের কার্যকর চিকিৎসা। এবং এতে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রথমে এ রোগে আক্রান্ত গরুকে গরুর খামার থেকে সরিয়ে পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে।মুখে এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে 0.01% পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে দিনে দুই থেকে তিনবার মুখ ধুয়ে নিতে হবে।

মশা মাছির উপদ্রব কমানোর জন্য অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। পায়ের ক্ষুরে ক্ষত হলে 0.01% পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। এসব রোগের বিভিন্ন তরল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। যেমনঃ

এফএম ডি কিউর (FMD-CURE)।এতে ভাইরাস সুপ্ত হয়ে থাকে।, প্রচন্ড পরিমাণ লালা ঝরলে গরু অনেক দুর্বল হয়ে যায় তাই স্যালাইন গরুর শিরায় পুশ করতে হবে ।এবং অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। গরুর মুখে ঘা থাকায় শক্ত খাবার পরিহার করে নরম ও তরল জাতীয় খাদ্য খেতে দিতে হবে।

গরুর ক্ষুরা রোগের নিয়ন্ত্রন

এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ভ্যাকসিন দিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিচর্যা ও নিয়ম মেনে গরুকে খাদ্য খাওয়াতে হবে।এবং গরুর প্রতি নজর দারির ব্যবস্থা থাকতে হবে ।লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে খামারে ময়লা আবর্জনা না জমে। এবং মাঝে মাঝে জীবানু নাশক ব্লিচিং পাউডার বা অন্যান্য তরল জাতীয় পদার্থ দ্বারা মেজে পরিষ্কার রাখতে হবে।

ভবিষ্যতে ক্ষুরা রোগ থেকে গরুকে বাঁচাতে সতর্কতাঃ

গরুর ক্ষুরা রোগ থেকে আপনার খামার বা গরু বাঁচাতে সব থেকে বেশি কার্যকর পদ্ধতি হলো ক্ষুরা রোগ সম্পর্কে সতর্কতা। কারণ গরুর ক্ষুরা রোগ, একটি ভাইরাস জনিত রোগ হওয়ার পাশাপাশি এ রোগ ছোঁয়াচে ও।সাধারণত গরুর ক্ষুরা রোগের আঁতুড়ঘর বলা হয় ময়লা ও নোংরা যুক্ত পরিবেশকে, তাই গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ দেখলে। তা প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে তা পয়েন্ট আকারে দেওয়া হল।
  • যেহেতু গরুর ক্ষুরা রোগ একটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই অপরিচিত কাউকে খামারের ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
  • খামারে আশেপাশে এলাকার পশু ও মশা-মাছি যাতে প্রবেশ না করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • প্রয়োজন ছাড়া গবাদি পশুকে বা আপনার গরুকে বাইরে চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
  • খামারের আশেপাশে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, খামারে প্রতিনিয়ত জীবাণু নাশক দিয়ে
  • পরিষ্কার করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষুরা রোগের উপযুক্ত টিকা প্রদান করতে হবে।
  • কোন গবাদি পশুকে আপনার খামারে প্রবেশ করানোর পূর্বে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, এবংপশুর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
উপরোক্ত পয়েন্ট গুলো মেনে চললে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সর্তকতা অবলম্বন ও সঠিক চিকিৎসা প্রদান করলে,আপনার গরুকে ক্ষুরা রোগ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। এছাড়াও আপনার গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার, পরীক্ষা ও প্রদানের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ভেটেনারি ডাক্তারের সাহায্য নিলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।

লেখকের মন্তব্য

ক্ষুরা রোগ একটি ভয়াবহ এবং ভাইরাসজনিত রোগ। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় অসংখ্য গরু এ রোগে মারা যায়। তাই গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে সতর্কতা হলে এ রোগ থেকে প্রায় ৫০% মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি গরুর ক্ষুরা রোগের নিয়ন্ত্রণ করা একান্তই জরুরী।

আপনার খামারে ক্ষুরা রোগ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গরুর ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে । এবং খামারে অবশ্যই বাইরের লোক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।বাইরের গরু বা গবাদি পশু থেকে আপনার গরু গুলোকে অবশ্যই আলাদা রাখতে হবে।এবং এই রোগের জন্য নিয়মিত Vaccine দিতে হবে।

বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধের জন্য চার থেকে ছয় মাস পর প্রথম টিকা এবং ২১ দিন পর দুইবার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এসব টিকা অনেক সময় কলেরা , ক্ষুরা, লাম্পি ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করে।অবশ্যই গর্ভবতী গাভীকে টিকা দেওয়ার সময় সতর্কীকরণ অবলম্বন করতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সলভ্ এ টু জেড এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url