পিপিআর রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার
আপনি কি আপনার ছাগলের পিপিআর রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।কিন্তু কিভাবে পিপিআর রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার করবেন সে সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করেছি কিভাবে আপনি পিপিআর রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার করবেন।
সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন। পিপিআর রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার ছাড়াও এ পোস্টে পিপিআর রোগের ঔষধ ,ভ্যাকসিন ,ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ টপিকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন ।
সূচিপত্রঃ পিপিআর রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার
.
ভূমিকা
পিপিআর রোগ হল একটি মারাত্মক ভাইরাস জনিত ও প্রাণঘাতী রোগ।পিপিআর রোগ এর সম্পূর্ণ নাম Peste des Petits Ruminants সংক্ষেপে (PPR)। এই রোগটির আঁতুরঘর বা সূচনা স্থল হলো আফ্রিকা মহাদেশে।পিপিআর রোগ মূলত ছাগল ও ভেড়াকে সংক্রমণ করে থাকে।এই রোগ বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গুলোতে এ রোগ প্রথম শনাক্তকরণ করা হয়। তবে ধীরে ধীরে এটি পুরো দেশের মধ্যে একটি মহামারী রোগ হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। আমাদের দেশে মোট অসুস্থ ছাগলের মধ্যে পিপিআর রোগে প্রতিবছর প্রায় ৭০ থেকে ৯০ ভাগ ছাগল মারা যায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পিপিআর রোগে প্রায় ১৫ লক্ষ ছাগল মারা গিয়েছে। এই রোগটি এতটাই মহামারি যে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ভ্যাকসিন হেটারোলোগাস এই রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে।
পশুর পিপিআর কি?
পিপিআর রোগের পুরো নাম হল পেস্ট্রি ডেস পেটটিস ইন রুমিন্যান্ট।এটি একটি মারাত্মক ভাইরাস জনিত রোগ।পিপিআর রোগ হচ্ছে একটি প্রাণঘাতী রোগ। পিপিআর রোগ Peste des petits Ruminants নামক এক ধরনের ভয়ংকর ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাসের নাম অনুসরণে,এ রোগের নাম দেওয়া হয় পিপিআর(P.P.R)।পিপিআর রোগ প্রায় সব গবাদি পশুকে প্রভাবিত করে। তবে এটি সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ করে ছাগলকে।
ছাগলের পিপিআর রোগের লক্ষণ কি?
যেহেতু পিপিআর রোগ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। তাই এই রোগ রোগান্ত পশুর দেহে প্রায় ৩ থেকে ৪ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আবার অনেক সময় ১০ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।আমাদের ছাগলের ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হলে আমরা পিপিআর রোগ বলে শনাক্ত করি।এতে আমাদের চিকিৎসা খরচ ও বাড়ে তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্যেকটি ছাগল খামারিদের পিপিআর রোগের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।নিচে ছাগলের পিপিআর রোগের লক্ষণ সমূহ পয়েন্ট আকারে দেওয়া হলো।
- পিপিআর রোগে রোগান্ত ছাগলের শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। পিপিআর রোগে রোগান্ত ছাগলের শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ১০৫ থেকে ১৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
- রোগান্ত ছাগলের ওজন অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে রোগান্ত ছাগল শুকিয়ে যায়।
- অনেক সময় অসুস্থ ছাগলের মারাত্মক ডায়রিয়া হয়ে থাকে। ডায়রিয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণ তরল পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে যায়, এর ফলে পিপিআর রোগে আক্রান্ত ছাগল পানি ও খনিজ লবন শূন্যতায় ভোগে।
- পিপিআর রোগে আক্রান্ত ছাগলের এক পর্যায়ে মুখ ফুলে যেতে পারে, এবং মুখের ভেতরে পাতলা ও নরম কোষ টিস্যু থাকে, যা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং দাঁতের গোড়ায় ঘা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত ছাগলের দাঁতের মাঝখানে ফাঁকে ফাঁকে , জিহ্বা , ঠোঁটে ,তালুতে ছোট ছোট ক্ষত তৈরি হতে পারে।
- পিপিআর রোগে আক্রান্ত ছাগলের চোখ আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আক্রান্ত ছাগলের চোখের পাতা ফুলে যেতে পারে। আর চোখের পাতা ফুলে যাওয়ার ফলে সেখানে ঘন দানাদার পদার্থ নিঃসৃত হয়ে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- আক্রান্ত ছাগলটি গর্ভবতী হলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
- পিপিআর রোগে আক্রান্ত ছাগলের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
- এছাড়াও ছাগলের নাক মুখ চোখ দিয়ে পাতলা তরল পদার্থ বের হয় এবং পরবর্তীতে তা ঘন হলুদ বর্ণ ধারণ করে, এবং ধীরে ধীরে ছাগলের নাকের ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ছাগলের শ্বাসকষ্ট দেখা যায়।
- আক্রান্ত ছাগলের খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয় বা খাবার রুচি কমে যায়। পিপিআর রোগে আক্রান্ত ছাগল যদি পিপিআর রোগে মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে,তাহলে ছাগল পুরোপুরিভাবে খাদ্য খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে।
- অল্পবয়সী ও মধ্য বয়সী ছাগলের পিপিআর রোগ বেশি দেখা দেয়।
ছাগলের পিপিআর রোগের চিকিৎসা
আপনার খামারে যদি পিপিআর রোগের লক্ষণ সমূহ দেখা দেয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব আপনার অসুস্থ ছাগলকে সুস্থ ছাগল থেকে বা আপনার ছাগলের খামার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।পিপিআর রোগ এক ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাস রোগ হওয়ায় এর কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে এ রোগের লক্ষণ অনুযায়ী ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য দীর্ঘ কার্যকরী এন্টিবায়োটিক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।
যেহেতু পিপিআর রোগ ছাগলের দেহে সর্বনিম্ন ৩ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাই প্রয়োজনে ৩ দিন পর পুনরায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। আপনার রোগান্ত ছাগলের যদি পাতলা পায়খানা হয়, সেক্ষেত্রে ছাগলের দেহে পানি শূন্যতা দেখা দিবে। এই কারণে আপনি আপনার ছাগলকে প্রচুর পরিমাণ স্যালাইন খাওয়াবেন।
সালফার জাতীয় ট্যাবলেট পিপিআর রোগের সুপ্তকাল পর্যন্ত অর্থাৎ তিন থেকে পাঁচ দিন খাওয়াতে হবে। এছাড়াও পিপিআর রোগের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা খুবই ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ পদ্ধতির নাম হল অ্যান্টি সিরাম অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
এছাড়াও পিপিআর রোগ বৃদ্ধি পেলে সিরাম ভ্যাকসিন,বড় ছাগলের জন্য প্রতিদিন ১০ সিসি এবং বাচ্চা ছাগলের জন্য ৩ থেকে ৫ সিসি করে ৩ দিন প্রয়োগ করতে হবে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে আক্রান্ত ছাগল ৫০ থেকে ৯০% সুস্থ হয়ে ওঠে।
এছাড়াও পিপিআর রোগের জন্য কার্যকারি অ্যান্টিবায়োটিক হলো সেফট্রিয়াক্সোন ,জেন্টামাইসিন ,ডেক্সট্রোজ ,মেলোক্সিকাম ইত্যাদি। এইসব এন্টিবায়োটিক আক্রান্ত প্রাণীদের কে সর্বোচ্চ ৫% দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু পিপিআর রোগ একটি ভাইরাস জনিত রোগ তাই এটির প্রতিষেধকের তুলনায় প্রতিকারই বেশি কার্যকর।
এ কারণে আপনার ছাগলের খামার প্রতিদিন জীবাণুমুক্ত করবেন। পিপিআর ভাইরাসের জন্য জীবাণু নাশক অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে, জীবাণুনাশক - ফেনল,সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড। এসব দিয়ে খুব সহজে পিপিআর রোগের জীবাণুকে ধ্বংস করা যাই।
ছাগলের পিপিআর রোগের ঔষধ
ছাগলের পিপিআর রোগ যেহেতু একটি ভাইরাস জনিত রোগ। তাই এ রোগ মারাত্মক অবস্থা ধারণ করলে আক্রান্ত ছাগল মারা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কিছু এন্টিবায়োটিক অধিক কার্যকরী হয়ে থাকে।সেসব অ্যান্টিবায়োটিক এর নাম পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো।
- সেফট্রিয়াক্সোন
- জেন্টামাইসিন
- মেলোক্সিকাম
- মাল্টিভিটামিন
- ডেক্সট্রোজ
পিপিআর ভ্যাকসিন এর দাম কত
আমাদের দেশে প্রায় বেশিরভাগ ছাগলই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই সরকার বিগত অর্থবছরে ছাগলের পিপিআর রোগ নির্মূলের জন্য প্রায় ৩৮ কোটি ৪১ হাজার টাকার ভ্যাকসিন ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলমান প্রকল্পের অধীনে এ ভ্যাকসিন ক্রয় নিয়ে চলছে নানা কুটকৌশল ও দুর্নীতি।
তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এইসব দুর্নীতিকে দমন করে প্রতিটি জেলায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। আপনি চাইলে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন, অথবা আপনার নিকটস্থ ডাক্তারের নিকট হতে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন আমদানি করতে পারেন। তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন সংগ্রহ করাই ভালো।
পিপিআর ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম
- প্রতিটি ছাগলের জন্য প্রায় এক মি.লি মাত্রায় কাধের নিচে টিকা বা ভ্যাকসিন পুশ করতে হবে।
- আক্রান্ত ছাগল যদি গর্ভাবস্থায় থাকে সেক্ষেত্রে শেষ ২১ দিন পর্যন্ত কোনো টিকা প্রদান করা যাবে না। কারণ এতে ছাগলের গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে।
- আক্রান্ত ছাগল যদি বাচ্চা হয়ে থাকে অর্থাৎ ছাগলের বয়স চার মাস হলে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। এবং পরবর্তী ছয় মাস পরে অবশ্যই বুস্টার ডোজ দিতে হবে। তবে দুই মাসের নিচে ছাগলকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না।
- আক্রান্ত ছাগলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পূর্বে প্রথমে ১০০ সিসি থেকে সিরিজ দিয়ে ১ সিসি ডায়ালুয়েট নিয়ে ভ্যাকসিন ভালো ভাবে ঝাঁকুনি দিতে হবে। এরপর উক্ত ঝাকুনিকৃত ভ্যাকসিন ১০০ ডায়াল্ড বোতলে স্থানান্তর করে ভালো হবে মিশাতে হবে।এবং অবশ্যই ডায়ালুট বোতলকে বরফের মধ্যে রাখতে হবে।
গর্ভবতী ছাগলের জন্য পিপিআর টিকা কি নিরাপদ?
অবশ্যই পিপিআর রোগের টিকা দুই মাসের বাচ্চা থেকে বয়স্ক ছাগল পর্যন্ত প্রায়ই সব ছাগলকেই দেওয়া যাবে। তবে টিকা দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে,যাতে টিকা দানকৃত ছাগলের বয়স দুই মাসের নিচে না হয়। এবং গর্ভবতী ছাগলের ক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসব করার আগে ২১ দিন সময়ের মধ্যে কোনো প্রকার টিকা দেওয়া যাবে না।
কারণ এতে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে ,তাই বলা যায় গর্ভবতী ছাগলের জন্য পিপিআর রোগের টিকা দেওয়া সব সময় নিরাপদ নয়। তাই অবশ্যই উপরোক্ত কথাগুলো মাথায় রেখে টিকা দেওয়া উচিত।
লেখকের মন্তব্য
আজকের আলোচনা হল ছাগলের পিপিআর রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার।আজকের মূল বিষয় হলো ছাগলের পিপিআর রোগ।এই রোগটি ভাইরাস জনিত রোগ তাই এর প্রতিষেধকের তুলনায় প্রতিকারই বেশি কার্যকর।
আমাদের ছাগলকে এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য, নিয়মিত ছাগলের বাসস্থান জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, আশেপাশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে। বাহিরে ছাগলে চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, এবং খামারে এই রোগ দেখা দিলে ,খামারের অন্যান্য সুস্থ ছাগলকে আক্রান্ত ছাগল থেকে আলাদা রাখতে হবে। আপনার ছাগল যদি এ রোগের মারাত্মক পর্যায়ে অবস্থান করে তাহলে অবশ্যই আপনাকে দ্রুত ভেটেনারি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ভাইয়া গভবতী ছাগল কে কী পিপিআর রোগের টিকা দেওয়া যাবে