গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার

আমাদের আজকের আলোচনা হলো গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার।আজকাল গরুর খামার  এর জন্য একটি ভয়াবহ ও পরিচিত রোগের নাম হল পেট ফাঁপা। এই রোগটি গরুসহ মানুষ  ছাগল , ভেড়া , মহিষ প্রায় সব প্রাণীকেই প্রভাবিত করে। অনেকেই এ রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তার শিকার হয় এবং এর রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য খুঁজে পায় না।
আজকে আর্টিকেলটি তাদের জন্য আজকের আর্টিকালে প্রধান আলোচনার বিষয় হলো গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ- চিকিৎসা ও প্রতিকার।এছাড়াও এ আর্টিকালে গরুর পেট ফাঁপা রোগে করণীয় ,স্থায়ী ও অস্থায়ী চিকিৎসা ও পেট ফাঁপা রোগের প্রতিরোধ সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।এসব গুরুত্বপূর্ণ টপিকের তথ্য জানতে আগ্রহী হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল।
সূচিপত্রঃগরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার
.

ভূমিকা

অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস কিংবা প্রচুর পরিমাণে খাবার গ্রহণের ফলে যদি হজম ক্রিয়া হ্রাস পায় এবং পেট ফুলে যায় তখন তাকে সাধারণত পেট ফাঁপা রোগ বলে। এ রোগ মানুষ সহ গরু ছাগল ও বিভিন্ন প্রাণীতে দেখা দেয়। ঠিক তেমনি রোমস্ত পশুর পেটে অতিরিক্ত গ্যাস জমে পেট ফাঁপা রোগের সৃষ্টি হয় এর কারনে পেট ফাঁপা জনিত রোগ বলে।
তবে গবাদি পশু বা গরুর পেটে শুধু মুক্ত গ্যাস জমা হলে তাকে টেম্পনি বলা হয় এবং গরুর পেটে যদি ফেনাযুক্ত বুদবুদ গ্যাস জমা হয় তাকে গরুর পেট ফাঁপা বা ব্লোট রোগ বলে।এ রোগ গরু ছাড়া ও প্রায় সব ধরনের প্রাণীতেই দেখা যায় এ রোগ সৃষ্টি হয় অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য খাওয়ার জন্য।

 আমাদের আজকের আলোচনা গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার আমি আশা করি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ে আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য খুঁজে পাবেন।

গরুর পেট ফুলে যাওয়ার কারণ?

আমরা যখন গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করতে যায়। তখন শুরুতেই একটি প্রশ্ন জাগে গরুর পেট ফুলে যাওয়ার কারণ কি? তাই প্রথমে সে সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।যখন কোন গরু লেগিউম সমৃদ্ধ কচি ঘাস অত্যধিক হারে খেয়ে ফেলে ( যেমন জার্মান ,পারা , এবং নেপিয়ার) ঠিক সে সময় সাধারণত গরুর পেট ফাঁপা রোগ দেখা দেয়।

এছাড়াও দ্রুত বর্ধনশীল কিছু ঘাস বা সিম জাতীয় খাদ্য রয়েছে যা গরুর পাকস্থলীতে বুদবুদ বাহানা যুক্ত গ্যাস সৃষ্টি করে। এই বুদবুদ বা ফেনাতে রেমিনাল সৃষ্টি হয়।যা গরুর গ্যাসকে গরু পাকস্থলীতে আটকে ফেলে এই কারণে গরু ঢেকুর দিয়ে গ্যাস গুলোকে আর বের করতে পারে না। আর এসব কারণে গরুর পেট ফাঁপা রোগের সৃষ্টি হয়।

আবার অনেক সময় বেশি পরিমাণ দানাদার খাদ্য( ভুসি , খুদের ভাত , গম , ছোলা) খেলে অথবা খাদ্যনালীতে কোন প্রকার সমস্যা সৃষ্টি হলে গরুর পেট ফেঁপে যায়।আবার অপরিপাক যোগ্য খাদ্য খাওয়ার ফলে ও গরুর পেট ফেঁপে যায় বা ফুলে যায়।

কোন খাদ্য অতিরিক্ত খেলে গরুর পেট ফাঁপা রোগ হতে পারে?

গবাদি পশু বা গরুর পেট ফাঁপার মূল কারণ হলো শর্করা জাতীয় জটিল খাদ্য। মূলত গবাদি পশু বা গরু যদি শর্করা জাতীয় খাদ্য অত্যাধিক পরিমাণে খেয়ে থাকে তবে গরুর পেট ফাঁপা সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই পেট ফাঁপা সমস্যা যাতে নতুন করে সৃষ্টি না হয় সেজন্য অবশ্যই আপনার গরুকে ফুলকপি ,বাঁধাকপি , এবং ব্রাসেলস ইত্যাদি খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে।


কারণ এতে অত্যধিক পরিমাণে শর্করা থাকে যা গরুর গ্যাস সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অবশ্যই এই খাবারগুলো আপনার গরুকে মাত্রা অতিরিক্ত খাওয়াবেন না ।এছাড়াও আরো বেশ কিছু খাবার খাওয়ালে গরুর পেট ফাঁপার সম্ভাবনা থাকে। সেই খাবার গুলো নিম্নে পয়েন্ট আকারে দেওয়া হল
  • কাঁঠালের শার বা খোসা তুলনামূলক বেশি পরিমাণে খাওয়ালে
  • প্রোটিন যুক্ত খাদ্য বা দানাদার জাতীয় খাদ্য বেশি মাত্রায় খাওয়ালে
  • হঠাৎ করে ইউরিয়া সার খাওয়ালে
  • শক্ত কোন বিচি বা খাদ্য যেমন তালের বিচি খাওয়ালে গরুর অন্ননালী বা খাদ্যনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে
  • শর্করা জাতীয় খাবার অত্যাধিক পরিমাণে খাওয়ালে ভাত,গম ,আটা ,ধান ,চাল ইত্যাদি।
আপনার গরু ও যদি এই পেট ফাঁপা রোগে  আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে উপরোক্ত খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকবেন।

গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ

সাধারণত পেট ফাঁপা রোগ হওয়ার সময় গরুর বিশেষ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়।যে লক্ষণ গুলো দেখে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার গবাদি পশু বা গরুর পেট ফাঁপা রোগ হয়েছে কি হয়নি। উক্ত লক্ষণ গুলো নিচে দেয়া হলো।
  • কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়
  • গরু জাবর কাটা বন্ধ করে দেয়
  • বারবার পেটে পা দিয়ে আঘাত করে।
  • দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস কার্য চালায়
  • গরু প্রস্রাব পায়খানার জন্য চেষ্টা করে কিন্তু প্রস্রাব ও পায়খানা করতে ব্যর্থ হয়।
  • গরুর চোখ ফুলে যায়।
  • হঠাৎ করে পেট ফুলে যায় যা গরুর বাম পাশে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়
  • এছাড়াও গরু দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যায়
  • গরুর খাদ্য খাওয়ার রুচি কমে যায়।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। একসময় তা শ্বাসকষ্টে পরিণত হয় ।
  • অতিরিক্ত গ্যাস জমে গবাদি পশু বা গরুর নাড়ি-ভুঁড়ি ও পেট ফুলে যায়।
  • অনেক সময় গরু মুখ খোলা রেখে জিহ্বা বের করে শ্বাস নেয়।
  • যথা সময়ে চিকিৎসা না করলে গরু শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাই।

পেট ফেঁপে গেলে কি করতে হয়?

এ রোগের একমাত্র প্রতিকার হল খুব সাবধানতার সাথে ও সঠিকভাবে খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এবং গরুর পরিপাকতন্ত্র ভালো ও উন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পেট ফাঁপা গরুকে প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী কমবেশি আদার রস ও সোডিয়াম বাই কার্বনেট খাওয়াতে হবে এবং সময়মতো গরুকে সঠিক নিয়মে কৃমিনাশক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।

এছাড়াও গরুর পেটে গ্যাস হলে ২৫০থেকে ৫০০মি. লি সয়াবিন তেল অথবা ১০০ থেকে ১৫০ মি.লি প্যারাফিন তেল খাওয়াতে হবে ।অথবা বাড়িতে থাকা এন্টাসিড ঔষধ বা ট্যাবলেট খাওয়ানো যেতে পারে।

গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার

আপনি যদি আপনার গরুকে পেট ফাঁপা রোগ থেকে মুক্ত রাখতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে বেশি কিছু বিষয়ে উপর নজর রাখতে হবে। যেমন
  • গরুকে বাসি খাবার খাওয়ানো যাবে না।
  • নিয়মিত গরুর খাবারের পাত্র জীবাণুনাশক( ব্লিচিং পাউডার অন্যান্য জীবাণু নাশক ঔষধ) দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
  • দ্রুত বর্ধনশীল জাতীয় ঘাস পরিমিত মাত্রায় এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য যেমন ভাত ,গম ,ধান ,চাল ইত্যাদি অল্প পরিমানে খাওয়াতে হবে।
  • গরুকে প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গরুর খাবারের এক পার্সেন্ট হারে খাবার সোডা বা আদার রস মিশিয়ে নিয়মিত খাওয়াতে হবে।
  •  গরুকে অধিক স্টার্চ জাতীয় খাবার নিয়ম অনুযায়ী খাওয়াতে হবে কখনোই বেশি পরিমাণ খাওয়ানো যাবে না।
  • মাঝে মাঝে গরুকে জাইমেট পাউডার খাওয়াতে হবে।
  • প্রতিদিন পরিমাণ মতো দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হবে।
  • ইউরিয়া ও গুড় মিশ্রিত খড় তৈরি সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে করে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া না থাকে।
উপরোক্ত টপিক গুলোর মধ্যেগরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে মোটামুটি আলোচনা করা হয়েছে। তাই উক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখলে গরুর পেট ফাঁপা রোগ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব তাই উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত প্রয়োজন।

গরুর পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা

গরুর পেট ফাঁপা বা ক্রনিক বোল্ট রোগ দু ধরনের হয়ে থাকে । যথাক্রমে
  • গরুর মাঝারি পেট ফাঁপা
  • গরুর মারাত্মক পেট ফাঁপা
তাই গরুর পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো

গরুর মাঝারি পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা ও করণীয়

গরুর পেট ফাঁপা যদি মাঝারি পরিমাণ হয় তাহলে স্টোমাক টিউবের সাহায্যে গরুর পেট থেকে গ্যাস বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।গরুকে পেট ফাঁপা কমানোর জন্য হাটতে হবে ও নড়াচড়া করাতে হবে । অবশ্যই গরুকে উত্তপ্ত জায়গায় না রেখে বাতাস চলাচল করে এমন ছায়াযুক্ত জায়গা রাখতে হবে । এবং অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গরুর মারাত্মক পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা ও করণীয়

যদি গরুর মারাত্মক পেট ফেঁপে যায় তাহলে সয়াবিন তেল ২৫০ থেকে ৫০০ মি.লি বা প্যারাফিন তেল ১০০ থেকে ১৫০ মি.লি খাওয়াতে হবে।যত দ্রুত সম্ভব গরুর পেটের গ্যাস বের করে দিতে হবে । তাই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত ধারালো ছুরি দিয়ে ১০ থেকে ২০ সে.মি গভীর করে ছিদ্র করতে হবে। এবং ভিতরের উদৃক্ত উপাদান গুলো হাত দিয়ে বের করে দিতে হবে ।

তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এ কাজটি করতে হবে। যদি শুধুমাত্র ঔষুধে পেট ফাঁপা রোগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে অবশ্যই ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। ওষুধের ব্যবহার বিধি ঔষধের গায়ে লিপিবদ্ধ থাকবে।

আর আপনার গরু যদি পেট ফাঁপার মারাত্মক পর্যায়ে অবস্থান করে , তাহলে ডাক্তারের আশায় বসে না থেকে খামারের মালিক নিজেই গরুর পেট ফাপা রোগের চিকিৎসা উদ্যোগ নিতে পারেন। এরপর ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে গরুর পেট পরিষ্কাকারের পর সেলাই করে নিতে হবে। প্রয়োজনে উক্ত রোগের যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে।পেট ফাঁপা রোগের কিছু এন্টিবায়োটিকের নাম নিচে দেওয়া হল
  • রুমেনটন
  • বায়োকোড্ এক্সপি
  • রুমকিওর
পেট ফাঁপা রোগের ঔষধ হিসাবে কিছু কার্যকরী পাউডারের নাম নিচে দেওয়া হল
  • রুমেইন প্লাস
  • বভি কেয়ার
  • জাইমোভেট
  • ডিজিটন
  • ডিজিম্যাক্স

লেখকের মন্তব্য

গবাদি পরশু বা গরুর পেট ফাঁপা রোগ একটি মারাত্মক অসুস্থতা যা গরুকে খুব বাজে ভাবে প্রভাবিত করে।এ রোগটি পারফিনজেন্টস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্টি যা দূষিত পরিবেশ ও নোংরা পানি ও খাবার খায় তখন গরুকে সংক্রমিত করে।এ রোগের কারণে গরুর পেট ফুলে যায় এটি এতই ভয়াবহ রোগ। সঠিক সময় চিকিৎসা করতে না পারলে গরু মারা যায়। 


তাই আক্রান্ত গরুকে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন ভাবেই গরু এ রোগে আক্রান্ত না হয়। যেহেতু এ রোগের প্রধান মাধ্যম হলো অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য তাই অবশ্যই খাদ্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। 

এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য খাওয়াতে হবে এবং যেসব খাদ্যে খাওয়ালে গরুর পেট ফাঁপা রোগের সংক্রমণ বেড়ে যায় সেসব খাদ্য পরিহার করতে হবে।আজকের আলোচনা ছিলো গরুর পেট ফাঁপা রোগের লক্ষণ - চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে়।এ আর্টিকেলটি পড়ে আশা করি আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সলভ্ এ টু জেড এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url