ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক, ঔষধ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

ধান গাছের পাতা পোড়া রোগ একটি ক্ষতিকারক ভাইরাস জনিত রোগ। অনেকেই ধানের পাতা পোড়া রোগ কে অনেকেই সাধারণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এটি ফসলের বিরাট ক্ষতি করে।এ রোগের আক্রমণের ফলে ধানের চারা গাছ শুকিয়ে মারা যায় ,এবং বয়স্ক অবস্থায় আক্রমণের ফলে ধানের পাতা ও কান্ড শুকিয়ে মারা যায়। ফলে ফসল উৎপাদনের হার প্রায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায়।
যার কারনে কৃষকরা ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়। এবং ফসল ফলানোর স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। আজকের আর্টিকেলে ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক, ঔষধ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনি যদি আপনার ধানক্ষেত কে এই মারাত্মক রোগের আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে চান, তাহলে অবশ্যই সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।

আজকের আর্টিকেলে একজন কৃষকের ধানের পাতা পোড়া রোগ কে প্রতিরোধ করার জন্য যতটুকু তথ্য জানা প্রয়োজন, তার সবটুকু তথ্য আলোচনা করা হয়েছে। তাই আর দেরি না করে চলুন শুরু করা যাক।
সূচিপত্রঃধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক, ঔষধ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
.

ধান গাছের পাতা পোড়া রোগের কারণ

সাধারণত পরিপক্ব ধান গাছের পাতায় মৌসুমের শেষে পাতা পোড়া রোগ দেখা যায়। এ রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে যেমনঃ
  • অত্যাধিক গরম বা আদ্র আবহাওয়া কারণে।
  • প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করার কারণে।
  • ঘন বা স্বল্প দূরত্বে চারা রোপন করার কারণে।
  • বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশ এই রোগ সৃষ্টি হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।
আপনি যদি আপনার ধান ক্ষেতে নাইট্রোজেন সার হেক্টর প্রতি ৪০ কেজি এর বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করেন, তাহলে আপনার ধানক্ষেত পাতা পোড়া রোগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই রোগটি ভালো পাতার চেয়ে আক্রান্ত পাতায় এরা খুব তাড়াতাড়ি বিকাশ লাভ করে।সাধারণত আক্রান্ত ধান, গাছের নাড়া ও আক্রান্ত ধান গাছের বীজ থেকে এই রোগের সংক্রমণ সৃষ্টি হয়।
তবে অবশ্যই আপনার ধানক্ষেতে সঠিক রোগ চিহ্নিত করতে হবে। আপনার ধান ক্ষেতে পাতা পোড়া রোগ না পাতা ঝলসা রোগ আক্রমণ করেছে তা নির্ধারণ করার জন্য, আপনাকে ধান গাছের পাতার আক্রান্ত অংশ কেটে পরিষ্কার পানিতে প্রায় ৫ থেকে ১০ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে।

এরপর উক্ত পাতা টিকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে যদি পাতা হতে ঘন তরল পদার্থ বেরিয়ে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে রোগটি পাতা পোড়া রোগ। আর যদি ঘন তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে তাহলে সে রোগটি
  • পাতা ঝলসা রোগ।
  • ধানের পাতা পোড়া রোগের লক্ষণ
সাধারণত ধানের পাতা পোড়া রোগ ধান গাছকে দুই কিস্তিতে আক্রমণ করে চারা অবস্থায় এবং বয়স্ক অবস্থায় তবে অবাক করার বিষয় হলো এ রোগ চারা এবং বয়স্ক গাছে আক্রমণ করলে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ সৃষ্টি হয়

চারা অবস্থায় ধানের পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ এর লক্ষণ

চারা অবস্থায় যদি আপনার ধানক্ষেত পাতা পোড়া রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাহলে চারাগুলো নেতিয়ে পড়ে তাকে। অনেক সময় এই রোগকে ক্রিসেক বলা হয়।ধানের চারা গাছের বাহিরের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা হরের রঙে পরিণত হয়। এমন অবস্থায় গাছের নতুন পাতাও
একইভাবে শুকিয়ে যায়। এবং ধারে চারা গাছ নেতিয়ে পড়ে। ধানের চারার গোড়ার অংশে হাত দিয়ে সামান্য চাপ দিলে পুঁজের মতো দুর্গন্ধযুক্ত সাদাটে তরল পদার্থ বের হয়ে আসে।আর এরকম পর্যায়ে আক্রান্ত হলে তাকে পাতা পোড়া রোগ বা ক্রিসেক বলে।

বয়স্ক অবস্থায় ধানের পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ এর লক্ষণ

বয়স্ক গাছে পাতা পোড়া রোগ খুব সহজে সনাক্ত করা যায় কারণ।পাতা পোড়া রোগের লক্ষণ গুলো অত্যন্ত প্রখর ভাবে প্রকাশ করে থাকে। বয়স্ক গাছ পাতা পোড়া রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রাথমিক অবস্থায়, পতার দুই কিনারে ছোট ছোট জল ছাপের মতো দাগ দেখা যায়।

এ দাগগুলো ধীরে ধীরে প্রহর ও বড় হতে থাকে এবং ধানের পাতার দুই প্রান্ত দিয়ে নিচের দিকে অগ্রসর হয় এবং আক্রান্ত অংশ বিবর্ণ হতে শুরু করে। যা পরবর্তীতে ধূসর বাদামি বর্ণের হয়।এ ধরনের লক্ষণযুক্ত রোগ কে পাতা পোড়া বা পাতা ঝলসানো রোগ বলা হয়।

আপনার ধানক্ষেতে এরূপ লক্ষণ প্রকাশ করলে আপনাকে ধরে নিতে হবে আপনার ধানক্ষেত পাতা পোড়া রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এবং এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োগ করতে হবে।

ধানের পাতা পোড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ

সাধারণত ধানের প্রায় সকল রোগকে দুই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এগুলো হলোঃ
  • জৈব নিয়ন্ত্রণ
  • রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
তবে ধানের পাতা পোড়া রোগ নিয়ন্ত্রণে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে এ রোগ শুধুমাত্র রাসায়নিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর প্রধান কারণ হলো এ রোগের বিরুদ্ধে জৈবভাবে বিকল্প কোনো দমন পদ্ধতি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।তাই এই রোগ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র অবলম্বন বা উপায় হলো রাসায়নিক ভাবে দমন।

ধানের পাতা পোড়া রোগের রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ

এ রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ না করে, যতদূর সম্ভব জৈব পদ্ধতিতে এ রোগের নিয়ন্ত্রণ করা উত্তম।
  • M.albescens- যুগানোর সংক্রমণ কমানোর জন্য থাইওফনেট ইথাইল দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
  • মাঠ পর্যায়ে ম্যানকোজেব,থায়োফেনেট মিথাইল দ্বারা ১.০ গ্রাম/ লিটার ফসলের পাতায় স্প্রে করলে ধান ক্ষেতে পাড়াপোড়া রোগের সংক্রমণ অনেকটা কমে যায়।
  • এছাড়াও উপরোক্ত ঔষুধ গুলো নির্দিষ্ট মাত্রায় ধান ক্ষেতে প্রয়োগ করলে ধান ক্ষেতের ছত্রাক জনিত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ধানের পাতা পোড়া রোগ প্রতিরোধে করণীয়

  • ধানের চারা তোলার সময় যাতে চারাই ক্ষত সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • পাতা পোড়া রোগে আক্রমণ প্রবণ ধানের চাষ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • অপ্রয়োজনীয় ইউরিয়া সার এর ব্যবহার বা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ইউরিয়া সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • ধান গাছের পাতা পোড়া রোগ দেখা দিলে ধান ক্ষেতের পানি ৭-১০ দিন শুকিয়ে রেখে দিতে হবে।
  • সম্পূর্ণ ইউরিয়া সার ধানের চারার কুশি অবস্থায় প্রয়োগ না করে, ২/৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
  • চারা অবস্থায় ধানের পাতা পোড়া রোগ দেখা দিলে, এ রোগে আক্রান্ত চারা তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। এবং পার্শ্ববর্তী গাছ থেকে কুশি এনে ফাঁকা স্থানে লাগাতে হবে।
  • ধান কাটার পর ধান খেতের অবশিষ্ট আবর্জনা( যেমনঃ নাড়া , খড়) পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • আপনার ধান ক্ষেতে যদি এ রোগের আক্রমণ অত্যাধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। তাহলে পাতা পোড়া রোগে আক্রান্ত জমিতে ৫০- ১০০ গ্রাম পটাশ সার,১০-১১ লিটার জলে মিশিয়ে পাঁচ শতাংশ জমিতে স্প্রে করুন। তবে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্তে এটি প্রয়োগ করা উত্তম।
  • ধানের পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ থেকে আপনার ধানক্ষেত কে মুক্ত রাখতে চাইলে পটাশ সার বিঘা প্রতি ৫/৬ কেজি উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • এছাড়াও কুপ্রাভিট ৪ গ্রাম এবং চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম প্রতি ১ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করুন।
আশা করি উপরোক্ত পদ্ধতি গুলো অবলম্বন করলে,আপনার ধান ক্ষেত খুব সহজে পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হবে। “ইনশাআল্লাহ”

ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক

ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক এর তুলনায় বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন, এ রোগ প্রতিরোধে বেশি কার্যকর হয়ে থাকে।যেমন
  • ধানের পাতা পড়া রোগে আক্রান্ত খেত হতে বীর সংগ্রহ না করা।
  • কুশি গজানোর সাথে সাথে সম্পূর্ণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা।
  • ধানের পাতা পোড়া রোগ প্রতিরোধী বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান,ধান ক্ষেতে রোপন করা।
  • এবং ধান ক্ষেত থেকে ফসল উত্তোলনের সময় ধানক্ষেতের অবশিষ্ট আবর্জনা,নাড়া,খড় পুড়িয়ে ফেলা।
উপরোক্ত সাবধানতা গুলো অবলম্বন করলে, ধানের পাতা পোড়া রোগ হতে ধান ক্ষেত মুক্ত রাখা যায়।তাই ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক এর ব্যবহার করা হয় না।

 ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক, ঔষধ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারঃ শেষ কথা

আজকের আর্টিকেলে ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক,ঔষধ,কারণ,লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আপনারা বিস্তারিত জেনেছেন। এবং আপনার ধান ক্ষেতকে কিভাবে ধানের পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা যায়, সে বিষয়ে আপনি একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেছেন।

আশা করি ধানের পাতা পোড়া রোগের কীটনাশক, ঔষধ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার আর্টিকেলটি সামান্যতম হলেও আপনার উপকারে এসেছে।এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এরকম কৃষি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে আমার ওয়েবসাইটে নিয়মিত ভিজিট করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সলভ্ এ টু জেড এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url